Looking Back - A Personal Journey Through Bangladesh's Political Landscape

[This post is written in Bengali, reflecting on personal experiences and political awakening in Bangladesh]

২০০১-২০০২ সাল থেকে আমার ছোটবেলার স্মৃতিগুলো মোটামুটি মনে আছে। তখন বিএনপির সরকার। আমি যখন ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করি, তখন আমার প্রথম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা হয় জাতীয় নির্বাচন দিয়ে। আমার মনে আছে, বাবার সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী বুথ দেখতে গিয়েছিলাম। সেই সময় আমাদের বাড়ির টিভিতে শুধু বিটিভি চলত। বেশিরভাগ সিনেমায় দেশ, সরকার ও প্রশাসনের যে চিত্রায়ণ দেখা যেত, তা বাস্তবের সঙ্গে কতটা মিল রয়েছে, সে বিচার করার মতো বোধবুদ্ধি তখন আমার ছিল না। তবে পুলিশের-প্রশাসন এবং সরকারের প্রতি মানুষের যে এক ধরনের ভয় ও ঘৃণা ছিল, সেটা স্পষ্ট মনে আছে।

২০০৫ সালের নভেম্বরে ঝালকাঠিতে যে বোমা হামলা হয়েছিল, তা দেখে সিনেমার দৃশ্যগুলো আমার কাছে সত্যি বলে মনে হতে শুরু করে। বাস্তব আর কল্পনার ফারাক তখন যেন ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল।

বিটিভিতে আমার প্রিয় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল "নতুন কুঁড়ি" এবং "মাটি ও মানুষ"। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল একটি অনুষ্ঠান, যা ছিল সার্ক নিয়ে, SAARC Audio Visual Exchange Programme, সংক্ষেপে SAVE। তখন আমি জিয়াউর রহমান, বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না।

২০০৬ সালে জেলা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় মূলত প্রথমবার বাংলাদেশের ইতিহাসের গভীরে ঢুকে জানতে শুরু করি। আমার এখনো মনে আছে, যখন জানতে পারলাম, সার্কের মতো একটি প্রতিষ্ঠান জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন আমার মানসিকতায় এক ধরনের পরিবর্তন আসে। তখনই প্রথম গভীরভাবে অনুভব করি সেই বাঙালি গর্বের আবেগ।

২০০৭-এর জানুয়ারিতে আমি জেলা স্কুলে ক্লাস ৩-এ ভর্তি হই।

জেলা স্কুলে ভর্তির পরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে। সেনাবাহিনী আমাদের স্কুলের ওখানেই ক্যাম্প করেছিল, যতদূর মনে পড়ে। আস্তে আস্তে দেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতে দেখি। মানুষের মুখে মুখে "আর্মি" শব্দটি ঘুরে বেড়াত। আমাদের স্কুলের বেশিরভাগ প্রধান শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত ছিলেন, কিন্তু তখন আমাদের সময় একমাত্র প্রধান শিক্ষক হিসেবে আসেন শফিকুর রহমান স্যার। তখন স্কুলে আমাদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করত; উল্টাপাল্টা করলে আর্মি নাকি ডলা দেয়! বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের অবস্থা তখন কি ছিল!

এই বছরই সিডরের তাণ্ডবে আমাদের জনপদ , রাস্তাঘাট সব বিপর্যস্ত হয়ে যায়। সেই বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের ভালোই বেগ পেতে হয়।

যাই হোক, ২০০৮-এর নির্বাচনের পরে ন্যারেটিভগুলো পরিবর্তন হতে থাকে।জানতে পারি, সার্কের প্রস্তাবক জিয়াউর রহমান হলেও মূলত এরশাদের আমলেই সার্ক প্রতিষ্ঠা হয়। আমার মনে আছে, স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা, তথ্য, ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে থাকে। ধীরে ধীরে আমি "প্রথম বাংলাদেশ আমার, শেষ বাংলাদেশ" গানটিকে মিস করতে শুরু করি কিন্তু ন্যারেটিভ পরিবর্তনের সমীকরণ তখনা আমার বুঝে আসেনি।

২০০৯ সালে নতুন সরকার আসার পর শুধু কুচকাওয়াজের ধারাভাষ্যই নয়, আমাদের পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসও বদলে গেল। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানার সেই নারকীয় ঘটনা ঘটল। আমি তখন ঢাকাতেই, ক্লাস ফাইভে পড়ি। ছোট্ট মনে সেই ঘটনা এক গভীর ক্ষত ও আতঙ্ক তৈরি করে, যা আমাকে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভেতরের সংঘাত নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।

আমার বরাবরই বয়সের চেয়ে বড়দের বই পড়ার অভ্যাস ছিল। ক্লাস ফাইভ-সিক্সেই আমি এসএসসি বা ইন্টার-এর বই ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। ক্লাস এইট-নাইনে ওঠার পর স্কুলের লাইব্রেরিটা আমার জগৎ হয়ে উঠল। এখানেই আমি প্রথম 'স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র' পড়া শুরু করি। পাঠ্যবইয়ের খণ্ডিত ইতিহাসের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের বিশাল, জটিল এবং রক্তাক্ত সেই চিত্র আমার চিন্তার জগৎকে পুরোপুরি বদলে দিল। আমি তখন আর শুধু জিয়া বা বঙ্গবন্ধুর সরলীকৃত গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাম না; আমি দেখছিলাম একটি জাতির জন্মযন্ত্রণা এবং তার পেছনের অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনি।

২০১৩ সালে যখন শাহবাগের আন্দোলন শুরু হলো, আমি ক্লাস নাইনে। দলিলপত্রে পড়া ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে রাজপথে নেমে এসেছে এমনই মনে হয়েছিল। 'জয় বাংলা' স্লোগান তখন আমার কাছে আর কোনো দলের স্লোগান ছিল না; ছিল এক ঐতিহাসিক চেতনার পুনঃজাগরণ। কিন্তু এর বিপরীতে হেফাজতের উত্থান সমাজের সেই গভীর বিভাজনকে সামনে নিয়ে এল, যা নিয়ে আমি দলিলপত্রে পড়েছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম, বাংলাদেশ নিয়ে ন্যারেটিভের একটা লড়াইটা চলছে।

২০১৫ সালে আমি কলেজে ভর্তি হলাম। বইপত্রে পড়া রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা আমাকে বাস্তব রাজনীতিতে অংশ নিতে আগ্রহী করে তুলল। ২০১৬-১৭ সালের দিকে আমি ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার একটা তীব্র ইচ্ছা আমার মধ্যে ছিল। ভেবেছিলাম, এটাই হয়তো দেশকে সেবা করার পথ।

কিন্তু খুব দ্রুতই আমি এর ভেতরের বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম। আদর্শের চেয়ে সেখানে 'ভাই-ব্রাদারের' আধিপত্য, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সন্ত্রাস আর হানাহানির চর্চা আমাকে হতাশ করল। আমি বুঝতে পারলাম, যে রক্তারক্তির ইতিহাস পড়ে আমি শিউরে উঠতাম, সেই একই সংস্কৃতির একটি ছোট সংস্করণ আমার সামনেই চলছে। আমি এর অংশ হতে চাইনি। তাই সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম।

ইন্টারমিডিয়েটের পর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চিরাচরিত পথে না হেঁটে কর্মজীবনে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিই। ২০১৭ সাল থেকে আমি ঢাকায় পুরোপুরিভাবে কাজ শুরু করি। প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র না থাকলেও ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে আমি রাজপথে ছিলাম। তখন আমার পরিচয় কোনো সংগঠনের কর্মী হিসেবে ছিল না; ছিল একজন সাধারণ সচেতন নাগরিক হিসেবে। কিশোর-কিশোরীদের সেই স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ আমাকে শিখিয়েছিল যে, পরিবর্তনের জন্য সবসময় রাজনৈতিক দলের পতাকা লাগে না; সাধারণ মানুষের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরই সবচেয়ে বড় শক্তি।

এরপরের বছরগুলো কেটেছে একজন কর্মজীবী তরুণ হিসেবে ঢাকাকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে। একদিকে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর মতো বিশাল উন্নয়ন দেখে মুগ্ধ হয়েছি, অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে বন্ধুদের আলোচনায় বাকস্বাধীনতার সংকোচন নিয়ে শঙ্কিত হয়েছি। শৈশবের সেই পুলিশের প্রতি ভয়টা যেন এক নতুন, অদৃশ্য রূপে ফিরে এসেছে।

অবশেষে ২০২৪ সালের সেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সবকিছুকে আবার ওলট-পালট করে দিল। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমার স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল, সেই একই রকম একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার মধ্যে আমি আমার কর্মময় যৌবনে এসে দাঁড়ালাম। ইতিহাসের কী অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি!

আজ ২০২৫ সালে এসে আমি পেছনের দিকে তাকাই। আমার যাত্রাটা আর পাঁচজনের মতো নয়। আমি প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির চূড়া ছুঁতে গিয়ে এর অন্ধকার দিক দেখে ফিরে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ছেড়ে কর্মজীবনের ব্যস্ততায় নিজেকে খুঁজেছি, কিন্তু দেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে রাজপথ থেকে দূরে থাকতে পারিনি। আমার বাংলাদেশ খোঁজার যাত্রাটা এখন আর বইয়ের পাতায় বা রাজনৈতিক তত্ত্বে সীমাবদ্ধ নেই; এটা এখন আমার দৈনন্দিন জীবন, আমার কাজ, আমার নাগরিক দায়িত্ব এবং আমার ভবিষ্যতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই যাত্রাটা এখনও চলছে। আর হ্যাঁ, ন্যারেটিভ পরিবর্তনের সমীকরণ টা এখন বোধ হয় কিছুটা বুঝে আসছে!


This reflection captures the personal journey of understanding politics, narratives, and change in Bangladesh from childhood to adulthood. It's a story of political awakening, disillusionment, and finding one's own path to contribute to society.

© Shahria Jaman Khan.RSS